বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নিরাপদ, বিশ্বস্ত এবং নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রস্তুতি নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়, যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ইউনেস্কো, এবং এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)-এর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়।
বুধবার (১০ জুলাই ২০২৪) ঢাকার আইসিটি টাওয়ারের বিসিসি অডিটরিয়ামে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভায় সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী, শিক্ষাবিদ, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন তাদের মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন।
সভায় শিক্ষা, পরিবহন, গার্মেন্টস, কৃষি এবং বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে এআই কৌশল, নীতি প্রণয়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সেক্টরগুলোতে সুনির্দিষ্ট এআই কৌশল না মানলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। বক্তারা উল্লেখ করেন, কৌশল ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক এআই নীতি কাঠামোর সাথে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা।
উদ্বোধনী অধিবেশনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক এআই প্রযুক্তির রূপান্তরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য নৈতিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এআই প্রযুক্তি যেন আমাদের সমাজে প্রযুক্তি বৈষম্য বৃদ্ধি না করে, বরং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনার পাশাপাশি সমাজের সকলের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে।”
আইসিটি বিভাগের সচিব মোঃ শামসুল আরেফিন সভার সভাপতির বক্তব্যে বলেন, “আমরা সকলের সুবিধার জন্য নৈতিক এআই-এর রূপান্তরকারী শক্তিকে কাজে লাগাতে চাই। আমরা এমন একটি নতুন ভবিষ্যত তৈরি করতে চাই, যেখানে এআই প্রযুক্তি আমাদের সমাজে নৈতিকভাবে অবদান রেখে একটি টেকসই স্মার্ট সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে।”
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মোঃ মাহমুদুল হোসেন খান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, “এআই-এর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এখন আমাদের সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর ও টেকসই কর্মকৌশল প্রণয়নে এআই অভিযোজনের সমস্যা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।”
এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও এজেন্সি টু ইনোভেট-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ ভূঞা বলেন, “আমরা ২০১৮ সাল থেকে এআই নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম, এর ফলে ২০১৯ সালে ‘এআই ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ২০১৯’ তৈরি হয়। এখন আমরা এআই নীতিমালা এবং এআই আইনে নৈতিকতার বিষয়টি সংযুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করছি।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদলের প্রধান চার্লস হোয়াইটলি বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউনেস্কোর এআই রেডিনেস অ্যাসেসমেন্ট মেথডলজির মতো উদ্যোগগুলোকে সমর্থন করে।” তিনি এআই প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে আইন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত বিবেচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ইউনেস্কো ঢাকার প্রধান হুহুয়া ফ্যান ওআইসি বলেন, “আজকের সংলাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের একত্রিত করা হয়েছে। এই আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে র্যাম কান্ট্রি রিপোর্ট এবং এর নীতিগত সুপারিশ তৈরি করার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করছি।”
ইউএনডিপি বাংলাদেশের ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি সোনালী দয়ারত্নে বলেন, “সব দেশই এআই দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, এবং উদীয়মান অর্থনীতির বৈশ্বিক এআই রেসে একটি কণ্ঠস্বর প্রয়োজন। সেই আওয়াজ দিয়ে আমরা বাংলাদেশের ক্ষমতায়ন করতে চাই।”
ইউনেস্কোর সামাজিক ও মানব বিজ্ঞানের সহকারী মহাপরিচালক গ্যাব্রিয়েলা রামোস বলেন, “ইউনেস্কোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত কথোপকথনকে কেবল একটি প্রযুক্তিগত বিষয় হিসেবে না দেখে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। এই প্রযুক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা উদ্দেশ্য নয়, বরং এর যথাযথ পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের লক্ষ্য পূরণ করে সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করাই মূল লক্ষ্য।”
প্যানেল আলোচনা এবং ব্রেকআউট গ্রুপ সেশনের মাধ্যমে নিরাপদ এবং বিশ্বস্ত এআই সম্পর্কিত ধারণা, এর নৈতিক ব্যবহার এবং এআই প্রযুক্তির সামাজিক প্রভাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে এআই প্রযুক্তির গ্লোবাল গভর্নেন্সের উপর একটি প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ইউনেস্কো সদর দফতরের সেকশন ফর বায়োইথিক্স অ্যান্ড দ্য এথিক্স অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-এর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট জেমস রাইট এবং ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের এডুকেশন প্রোগ্রাম সেক্টরের প্রধান হুহুয়া ফ্যান। আলোচনা পরিচালনা করেন ইউএনডিপির সিনিয়র গভর্নেন্স স্পেশালিস্ট শীলা হক।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মোঃ আফজাল হোসেন সারওয়ার, হেড অব ফিউচার অব এডুকেশন, এটুআই; ড. জুলকারিন জাহাঙ্গীর, রিসার্চ স্পেশালিস্ট, এটুআই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত ইউনেস্কোর বৈশ্বিক সুপারিশের প্রাসঙ্গিকতা এবং গুরুত্ব মাথায় রেখে বিভিন্ন সেক্টরে এআই ব্যবহারের নৈতিক প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন আমন্ত্রিত অতিথিরা।
মোঃ মামুনুর রশীদ ভূঞা, রুমানা শারমিন এবং ইউনসং কিমের নেতৃত্বে গ্রুপ প্রেজেন্টেশন এবং এআই ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কিত একটি মূল্যায়ন অধিবেশনের মাধ্যমে মতবিনিময় সভা সম্পন্ন হয়। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত সুপারিশ’ ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে।
এছাড়া ডঃ ফারিগ ইউসুফ সাদেক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর সহযোগী অধ্যাপক, এআই প্রযুক্তির মৌলিক ধারণা এবং তাদের সম্ভাব্য ঝুঁকির নানা দিক উপস্থাপন করেন। ইউনেস্কো দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিসের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ইউনসং কিম এআই উন্নয়নে নৈতিক মাত্রা বিবেচনা করার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে কাজ করছে। ইউনেস্কো এবং ইউএনডিপি সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার এআই সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি, নীতি কাঠামোর উন্নয়ন ও প্রসার, এবং এর নিরাপদ-বিশ্বস্ত-নৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারের এই উদ্যোগের সাথে এটুআই যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সেক্টরে নীতিনির্ধারণ এবং এআই-সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে।