বাংলাদেশের তরুণদের মানসিক অসুস্থতার পেছনে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব প্ল্যাটফর্মের আসক্তি কমাতে লোকদেখানো কার্যক্রমের পরিবর্তে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি ডেটা বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও, উচ্চপ্রযুক্তির মেন্টাল হেলথ জিপিটি তৈরি এবং এর মাধ্যমে দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকে ব্যবহার এবং ৩৫০ সংসদ সদস্যকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) রাজধানীর আগারগাঁও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), ইউএনডিপি বাংলাদেশ এবং মনের বন্ধু’র যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘আইসিটি অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ’ গোলটেবিল আলোচনা সভায় প্রতিমন্ত্রী এসব কথা জানান।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের সার্বিক সহযোগিতায় মনের বন্ধু বাংলাদেশের স্বনামধন্য দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মেন্টাল হেলথ এবং সাইকোসোশ্যাল সাপোর্ট’ পাইলট প্রকল্পের সমাপ্তি উপলক্ষে এবং সারা বাংলাদেশে আরও সক্রিয়ভাবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে এই ‘পলিসি রাউন্ড টেবিল’ আয়োজন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, দেশে এখন সাড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরিদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে এবং তারা মনের অজান্তেই নেগেটিভ কন্টেন্টে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে সকলকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছা করলেই পৃথিবীর সব নেগেটিভ কন্টেন্ট মুছে ফেলতে পারব না বা সাইবার বুলিং বন্ধ করতে পারব না। তবে মেন্টাল হেলথ, ডিজিটাল এবং এআই লিটারেসি নিয়ে সকলকে সচেতন করতে পারব। এজন্য সরকার, বেসরকারি খাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়াকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এছাড়াও, প্রতিমন্ত্রী বলেন, ফেসবুক, টিকটক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ এসব প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। “এই মাল্টিন্যাশনাল সোশ্যালমিডিয়া ডিপ ফেইক টেক কোম্পানিগুলো মূল অপরাধী। তাদেরকে প্রথমে দায়ী ও দোষী করতে হবে এবং তাদেরকে টেবিলে এনে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে।”
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদা শিরোপা বলেন, মনের বন্ধু একটি প্রযুক্তি ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য স্টার্টআপ। আইসিটি ডিভিশন এবং স্টার্টআপ বাংলাদেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা এডভান্সড টেকনোলজি ও এআই-এর সহায়তায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করছি। ইউএনডিপি বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে আমরা গত ৬ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করেছি যার মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা ও সাইবার বুলিং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিটি বিভাগের সচিব সামসুল আরেফিন, বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. বুশরা বিনতে আলম, ইউএনডিপির সিনিয়র গভর্নেন্স স্পেশালিস্ট শিলা তাসনিম হক এবং পিটিআইবির প্রোজেক্ট ম্যানেজার রবার্ট স্টোয়েলমান, এনআইএমএইচের প্রফেসর ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদা শিরোপা। অনুষ্ঠানে আইসিটি বিভাগ ও ডিজি হেলথ সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানকারী, বিভিন্ন দূতাবাস, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্মী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ সংস্থার কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সাইবার বুলিং ও অনলাইন ক্ষতি মোকাবিলায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক পরিষেবা (এমএইচপিএসএস) চালু করার বিষয়ে আইসিটি ডিভিশন এবং ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এবং ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ২০২০-২০৩০ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অগ্রগতির জন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে শুরু হওয়া পাইলট প্রকল্প সফলভাবে ২০২৪ সালের মে মাসে শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১২০ জন শিক্ষার্থীকে মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা একজন ‘মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট রেসপন্ডার’ হিসেবে তাদের সহপাঠীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রাথমিক সহায়তা প্রদান করতে পারে। গত ছয় মাসে এই ‘মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট রেসপন্ডারদের’ কাছে ৪৩০ জন শিক্ষার্থী মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা চেয়েছেন। এছাড়াও, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮০০ শিক্ষার্থীকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য টেকসই পরিবেশ এবং সাইবার বুলিং এর বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।